সংসদ নির্বাচন : চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টাইল
- শাহজাহান সামিরী
- ২৬ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৯
নতুন বছরের শুরুতে গত ১ জানুয়ারি নয়া দিগন্তে তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছোট্ট একটি প্রতিবেদন শিরোনামসহ হুবহু তুলে ধরা হলো। ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনে হস্তক্ষেপবিহীন ভোটে দুটিতে বিএনপির জয়লাভ।’ এতে লেখা হয়েছে- একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সুষ্ঠু ও হস্তক্ষেপবিহীন নির্বাচন হয়েছে। এ জেলার তিনটি আসনের মধ্যে দুটিতে বিএনপি এবং একটিতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার চার লাখ ১৬ হাজার ৫৪ জন। এ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের সামিল উদ্দিন নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার ৭৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাজাহান মিঞা পেয়েছেন এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৫০ ভোট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৮২ হাজার ৫৫৬ জন। বিএনপির আমিনুল ইসলাম এক লাখ ৭৫ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, আওয়ামী লীগের জিয়াউর রহমান পেয়েছেন এক লাখ ৩৬ হাজার ৫২ ভোট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৮২ হাজার ৫৫৪ জন। বিএনপির হারুনুর রশিদ এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৬১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আবদুল ওদুদ পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৯৩৮ ভোট। এ ছাড়া আপেল প্রতীকে জামায়াতে ইসলামীর নুরুল ইসলাম বুলবুল ৫৯ হাজার ৫৭০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে তারা জোটে থাকলেও এ আসনে বিএনপি ও জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনের দিন এ তিনটি আসনে ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কেন্দ্রেই সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। সকাল থেকেই ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। বিচ্ছিন্নভাবে দু’-একটি কেন্দ্র ছাড়া জাল ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। প্রশাসনের ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ। কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় সব দলের পোস্টার, ফেস্টুন দেখা গেছে। নেতাকর্মীরাও কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নিয়েছেন শান্তিপূর্ণভাবে।”
প্রতিবেদনটি মোটামুটি চমৎকৃত করার মতো। নির্বাচনের স্বাভাবিক একটি মেজাজ আছে। হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে তার মেজাজ ও পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রকাশিত হয়ে ওঠে। এটা ফুটে উঠেছে এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনটি আসনের নির্বাচনে। বর্তমান বাংলাদেশে ভোট নাটকের প্রতি চপেটাঘাত যেন এই নবাবগঞ্জের নির্বাচন।
প্রায় সর্বত্র অনিয়ম পরিণত হয়েছে নিয়মে। অনৈতিকতা সদম্ভে দখল করেছে নৈতিকতার পবিত্র জায়গাটি। সত্য বিতাড়িত হয়েছে মিথ্যার দাপটে। বিবেক গেছে ‘বেড়াতে’ ঊর্র্ধ্বগগনে যেন স্থায়ী ঠাঁই নিয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অনুশাসন গেছে ‘নির্বাসনে’; শিষ্টাচার পরাজিত হয়েছে অশিষ্টাচারের কাছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাচন এ প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি করেছে অনুপম এক দৃষ্টান্ত। কলুষিত নির্বাচনের মধ্যে এ এক অনন্য ব্যতিক্রম।
এ কৃতিত্ব সবার। সমবেত প্রচেষ্টার ফসল এটা। প্রশাসনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থক, ভোটারসহ সর্বস্তরের নাগরিক- সবার অবদান এতে নিহিত। প্রত্যেকের দেশপ্রেম, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ এবং মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এর পেছনে। এসব দেখে বলতে ইচ্ছা করছে, না, বিবেক শেষ হয়ে যায়নি। তারই ছোট্ট একটি নজির চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেখা গেল।
বিবেক যখন আঁধারে পথ হারিয়ে দিশাহীন, তখন একটি অতিক্ষুদ্র এলাকা নিভুু নিভু আলো ছড়াল ৩০ ডিসেম্বর । আমরা আশা করব, এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড থেকেই টিমটিমে বিবেকের বাতিটি পুরো দেশকে আলোময় করে তুলবে ক্রমে ক্রমে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোটের ফলাফলে দেখা যায় : আসন-১ : বিজয়ী ও বিজিত উভয় প্রার্থীই ভোট পেয়েছেন প্রচুর। তুমুল প্রতিযোগিতায় একজন বিজয়ী হয়েছেন। ভোট প্রাপ্তির পার্থক্য ১৬ হাজার ৪২৮। ভোটারদের উপস্থিতি ৮২.৬১ শতাংশ। অন্যান্য প্রার্থীর ভোট যোগ করলে উপস্থিতির হার কিঞ্চিৎ বাড়বে।
আসন-২ : জয়ী এবং পরাজিত প্রার্থী বহু ভোট পেয়েছেন। ভোট প্রাপ্তির প্রভেদ ৩৮ হাজার ৫১৪। ভোটার উপস্থিতি ৮১.৬৬ শতাংশ। অন্যান্য প্রার্থীর ভোট যোগ করলে একটু বাড়বে। আসন-৩ : এ আসনে শক্তিশালী প্রার্থী তিনজন। সবাই অনেক ভোট পেয়েছেন। তিনজন প্রার্থী থাকার কারণে বিজয়ী এবং বিজিতের ভোটে পার্থক্য কিছুটা বেশি; তারপরও অস্বাভাবিক নয়। পার্থক্য হলো ৪৭ হাজার ৭২৩। ভোটার উপস্থিতি ৭২.৯৭ শতাংশ। অন্য প্রার্থীদের ভোট প্রাপ্তিও যোগ করলে একটু বাড়বে।
দেখা যাচ্ছে, প্রধান প্রার্থীদের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা হয়েছে। ভোট প্রাপ্তির তারতম্যে অবিশ্বাস্য বা হতবাক করার মতো কিছু নেই। প্রার্থীরা ‘ঝামেলাহীন’ প্রচারণা চালিয়েছেন। পোস্টার ও ফেস্টুুন লাগাতে প্রতিবন্ধকতা ছিল না বলে মনে হয়। সবার ছিল অনেকটা সহাবস্থান। বলা যেতে পারে, নির্বাচনী মেজাজ ছিল প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক।
খেলায় হারজিত আছে । কে হারল আর কে জিতল, তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, খেলার মাঠও সমতল কি না; সব খেলোয়াড় সমভাবে সুযোগ-সুবিধা পেলেন কি না। নির্বাচনী মাঠের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে বহু উপাদান ও উপকরণ। এটাই বাঞ্চিত যে, প্রার্থীদের (প্রতিযোগীদের) প্রচারণার জন্য ভোটের ময়দান থাকবে উন্মুক্ত এবং সমতল। প্রত্যেকে পাবেন সমান সুযোগ প্রচারণার জন্য। কেউ কাউকে বাধা দেবে না। কেউ কারো ওপর হামলা করবে না। প্রশাসনকে থাকতে হবে নিরপেক্ষ। ভোটকেন্দ্র থাকবে উৎসবমুখর ও ভয়-ভীতিহীন। থাকবে গণতান্ত্রিক সহাবস্থান। তবে এবার দেশের চিত্রটা সার্বিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত বা অস্বাভাবিক ছিল। প্রায় সর্বত্র ভোটের দিনও পরিবেশ ছিল অস্বস্তিকর। ভোটের মাঠের প্রচার-প্রচারণা আগাগোড়াই ছিল পরিকল্পিতভাবে একতরফা। শুধু ক্ষমতাসীন দল বা জোট ছিল মাঠে। পোস্টার ফেস্টুনের ক্ষেত্রেও তা দেখা গেছে।
বাংলাদেশে দুই প্রধান দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুটো দলই জনপ্রিয়। এবারের ভোটের ফলাফলের চিত্রটা হয়ে গেছে অন্যরকম। অস্বাভাবিক এবং অবিশ্বাস্য। জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ব্যতীত (মডেল হয়ে থাকতে পারে নবাবগঞ্জের নির্বাচন) বাংলাদেশের সর্বত্র বিজয়ী এবং বিজিতের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ‘আসমান-জমিন ফারাক’। বিরোধী দলের বাঘা বাঘা প্রার্থীর নসিবে জুটেছে স্বল্পসংখ্যক ভোট। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন দলের এবং জোটের ললাটে জমা পড়েছে পর্বতসম ভোট। সংশয়টা এখানেই। ক্ষমতাসীন বলয়ের বাইরে সব দলের রয়েছে এই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে এন্তার অভিযোগ। বলা যেতে পারে, অভিযোগের পাহাড়।
আশা করা হয়েছিল, দলীয় সরকারের অধীনে এবারের প্রথম নির্বাচন হবে প্রশ্নমুক্ত ও অভিযোগহীন। কিন্তু তা আর হলো না। অনেক প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেল ব্যাপকভাবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে- সবার এটাই ছিল একান্ত প্রত্যাশা। কিন্তু তা
আর হলো না। পোড়া কপালই আমাদের এ জাতির।